প্রকাশিত:
১৮ অক্টোবার ২০২৫, ১৯:৩৬
দীর্ঘ যুদ্ধবিরতির পর প্রথমবারের মতো গাজার মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ধ্বনিত হলো আজানের সুর। ক্ষতবিক্ষত, ধ্বংসস্তূপে ঘেরা শহর জুড়ে হাজারো ফিলিস্তিনি শুক্রবার জুমার নামাজে অংশ নিয়েছিলেন। মসজিদ ফিলিস্তিনিদের জন্য শুধু নামাজের স্থান নয়, বরং তাদের আশ্রয়স্থলও।
গাজা উপত্যকার ধ্বংসপ্রাপ্ত ও অর্ধভাঙা অসংখ্য মসজিদে শুক্রবার দুপুরে একসঙ্গে ভেসে আসে তাকবির ধ্বনী—আল্লাহু আকবার। এক সপ্তাহ আগে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর এটিই ছিল প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে একত্রে অনুষ্ঠিত জুমার নামাজ।
দুই বছরের অবরোধ ও রক্তক্ষয়ের পর গাজা নগরীর ঐতিহাসিক সাইয়্যেদ হাসেম মসজিদে নামাজ পড়েন স্থানীয় বাসিন্দা গালিদ আল-নিমরা। আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বলেন, দুই বছরের বিচ্ছিন্নতার পর একসঙ্গে নামাজ পড়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
গাজা সিটির পুরনো অটোমান আমলের দরজা পেরিয়ে মুসল্লিরা দলে দলে মসজিদে প্রবেশ করেন। কেউ দাঁড়িয়েছিলেন, কেউ সিজদা করছেন, সবার চেহারায় ছিল গাম্ভীর্য, চোখে ছিল অশ্রু।
হামাসের তথ্যমতে, গাজার মোট ১,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ১,১৬০টিই আংশিক বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। তবুও সেই ভগ্নস্তূপের মাঝেই যুদ্ধ বিরতির পর গাজাবাসী ফিরে পেয়েছেন আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানোর শক্তি।
উত্তর গাজার বাস্তুচ্যুত এক বাসিন্দা আবু মাহমুদ সালহার এলাকার আল-ফালুজা মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে; তিনি এখন রাস্তায় নামাজ পড়েন। তিনি বলেন, এত ধ্বংস আর মৃত্যুর মাঝে মনে হয় নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। এখন তাবুতে নামাজ পড়ি, কিন্তু জুমার জামাতে ইমামের কণ্ঠ শুনতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠে।
অনেকে ভাঙা মসজিদে, আবার কেউ কেউ ধ্বংসস্তূপে বা খোলা আকাশের নিচে জায়নামাজ বিছিয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন।
বাস্তুচ্যুত হয়ে দেইর আল-বালাহ শহরে আশ্রয় নিয়েছেন ২৭ বছর বয়সী মোয়াতাজ আবু শরবি। তিনি বলেন, আমরা এখন বালির ওপর বা কার্ডবোর্ডে নামাজ পড়ি, এটা মানসিকভাবে ভীষণ কষ্টের। মসজিদ ছিল আমাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু, আমাদের আত্মার আশ্রয়। ঘর হারানো যেমন বেদনার, তেমনি মসজিদ হারানো আরও গভীর আঘাতের।
গাজা সিটির আল-শাতি শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা আবু মোহাম্মদ আল-হাত্তাব বলেন, আমার বাড়ির পাশের মসজিদটা শুধু নামাজের জায়গা ছিল না; সেখানে আমরা শান্তি খুঁজতাম, আল্লাহকে স্মরণ করতাম। যখন সেটা ধ্বংস হলো, মনে হলো হৃদয়ের একটা টুকরো যেন হারিয়ে গেল।
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরের আলবানী মসজিদের ভগ্নাবশেষেও শুক্রবার নামাজ পড়েন শত শত ফিলিস্তিনি। দেয়াল ভেঙে পড়া, ছাদ ধ্বসে যাওয়া সেই মসজিদে এক ইমাম লাউডস্পিকারে খুতবা দেন, আর উপস্থিতরা চোখ মুছে দোয়ায় মগ্ন হন।
২২ বছর বয়সী সালিম আল-ফাররা বলেন,আমরা আশা করি, গাজার সবকিছু এবং মসজিদগুলোও একদিন পুনর্নির্মিত হবে।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের অভিযানে নিহতদের মধ্যে ২২ হাজারের বেশি ছিলেন যোদ্ধা, আর অক্টোবর ৭-এর হামলায় ইসরায়েলের ভেতরে আরও ১,৬০০ হামাস সদস্য নিহত হয়েছেন। তবে সেই হিসাব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে।
ধ্বংসস্তূপের মাঝেও ফিলিস্তিনিরা আজ আবার মাথা নোয়ালেন মহান আল্লাহর সামনে।
ভাঙা মিনারের ছায়ায়, ধুলোমাখা জায়নামাজে, তারা প্রমাণ করলেন গাজার মসজিদ ভাঙা যেতে পারে, কিন্তু মুসলমানের ঈমান ভাঙা যায় না।
সূত্র : টাইমস অব ইসরায়েল, রোয়া নিউজ
ডেস্ক/ই.ই
মন্তব্য করুন: