১৫শ শতাব্দীর কিংবদন্তি আরব নাবিক আহমাদ ইবনে মাজিদ। তাকে ‘সমুদ্রের সিংহ’ বলা হয়। আধুনিক সমুদ্রপথ এবং নাবিকশাস্ত্রে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন তিনি।
সমুদ্র পথের দিক নির্ণয়ের জন্য নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। তার উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো— উন্নত কম্পাস, দিগন্ত নির্ণায়ক বৃত্ত (অ্যাস্ট্রোল্যাব), সমুদ্রপথের সঠিক মানচিত্র।
ভারত মহাসাগরের বাণিজ্যপথ নিরাপদ ও সহজতর করতে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। বিভিন্ন জাতি, ভিন্ন ভাষাভাষী নাবিকেরা তার কাছ সমুদ্রবিদ্যা শিখেছিলেন।
আহমাদ ইবনে মাজিদ ১৪২১ সালে বর্তমান ওমানের সমুদ্র উপকূলের রাশ আল খাইমাহর জুলফার শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
আহমাদ ইবন মাজিদের বাবা নিজেও সমুদ্রবিদ্যার বিশেষ জ্ঞান রাখতেন। তিনি ছেলের সমুদ্রবিদ্যার পাশাপাশি কোরআন এবং ধর্মীয় শেখার প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শৈশবেই তিনি কোরআন, ধর্মীয় এবং জাহাজ চালনায় পারদর্শীতা অর্জন করেছিলেন।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ধর্মীয় ও নাবিকশাস্ত্রের সম্পূর্ণ জ্ঞান আহরণ করেছিলেন। এ বয়সেই তিনি সমুদ্রে জাহাজ চালিয়েছিলেন। তিনি জাহাজের ‘মাস্টার মেরিনার’ পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছিলেন।
পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছেছিন ভাস্কো দা গামাকে আফ্রিকা থেকে ভারতের পথ দেখানোর ঘটনায়, তবে গবেষক জি.আর. টিবেটস এই দাবিকে অস্বীকার করেছেন।
ইরানে জন্ম নিয়েছেন যেসব মুসলিম মনীষী
নাবিকদের কম্পাসের উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন আহমাদ ইবন মাজিদ। যদিও চীনা নাবিকরা আরও ৫০০ বছর আগে থেকে এমন যন্ত্র ব্যবহার করছিলেন, তবে কম্পাসকে স্থিতিশীল করার জন্য কম্পাসের সকল অংশ একত্রিত করে একটি দোলন বাক্সে স্থাপন করেন তিনি।
তিনি ‘কামাল’ নামের বিশেষ একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন, এটি আজও কিছু নাবিক ব্যবহার করেন। এই যন্ত্রটি ছিল মূলত একটি কাঠের ট্যাবলেট সদৃশ্য এবং বদ্ধ দড়ি দ্বারা তৈরি, এর সাহায্যে নাবিকরা উত্তর তারা ও ল্যাটিটিউড নির্ধারণ করতে পারতেন।
নাবিকশাস্ত্র ও সমুদ্রপথ সম্পর্কিত সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। তার প্রথম সংকলন ছিল ‘কিতাব আল-ফাওয়াইদ’ (সমুদ্র ও নাবিকশাস্ত্রের পাঠগ্রন্থ)। এ গ্রন্থে তিনি সমুদ্রপথের ইতিহাস, আরব বণিজ্য নেটওয়ার্ক এবং উচ্চসমুদ্র ও উপকূলীয় নাবিকতার মূলনীতি বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও তিনি ঝড়, মনসুন ও সামুদ্রিক ঝাপটের প্রভাবের বিশ্লেষণ করেছেন।
ইবন মাজিদের সর্বাধিক পরিচিত কৃতিত্ব হলো ‘ফাওয ফি উসুল ইলম আল-বাহর ওয়াল কওয়াইদাহ’, যা সমুদ্রবিজ্ঞান ও নাবিকশাস্ত্রে যুগান্তকারী একটি গ্রন্থ। এই বইটিমন এক সময়ের লিখেছিলেন যখন ওসমানীয় সাম্রাজ্য এবং ইউরোপের কাছে ভারত মহাসাগরের সীমিত তথ্য ছিল আর তখন আরব বিশ্ব সমুদ্রবিদ্যায় ছিল সমৃদ্ধ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আহমাদ ইবন মাজিদ গ্রিক, তামিল, ফার্সি এবং পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন উপভাষা শিখেছেন। ধর্মীয় ও বৌদ্ধিক জ্ঞান অর্জন করে তিনি কাব্য রচনা ও সমুদ্রভ্রমণ সংক্রান্ত সাহিত্যেও অবদান রেখেছেন।
সমুদ্রভ্রমণ এবং জীবন দর্শনের সংমিশ্রণে তিনি প্রায় চল্লিশটি কবিতা ও প্রবন্ধের বই লিখেছিলেন।
সমুদ্রপথ ও বাণিজ্যে তার দূরদর্শী পরিকল্পনা, সূক্ষ্ম প্রজ্ঞা এবং লিখিত গ্রন্থাবলী আজও নাবিক এবং গবেষকদের জন্য নির্দেশিকা হিসেবে বিদ্যমান। আজও তার হাতে লেখা দুটি গ্রন্থ প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে প্রধান প্রদর্শনী হিসেবে সংরক্ষিত।
সূত্র : আল জাজিরা, ওমান ডেইলি অবজারভার, দ্য ন্যাশনাল
ডেস্ক/ই.ই
মন্তব্য করুন: